মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৩
spot_img
বাড়িসারা বাংলাআপিল নিষ্পত্তির আগেই ফাসি কার্যকর। দেশব্যাপি আলোচনা

আপিল নিষ্পত্তির আগেই ফাসি কার্যকর। দেশব্যাপি আলোচনা

যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা মামলার দু’ আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে আপিল নিষ্পত্তির আগেই। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে চুয়াডাঙ্গার মনোয়ার মেম্বর হত্যা মামলায় তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। যাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে তারা হচ্ছেন,পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা মোকিম ও ঝড়ু। তবে,কারা সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র দাবি করেছে আইনগত সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয় সেই সময়।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ভার্চ্যুয়াল বেঞ্চে শুনানির জন্যে বৃহস্পতিবার কার্যতালিকায় (কজলিস্টে) ছিল মামলাটি। কিন্তু শুনানি হওয়ার আগেই জানা যায় আসামিদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়ে গেছে। আপিল আবেদনকারী আইনজীবী আসিফ হাসান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, তিনি আসামিপক্ষের আইনজীবী হিসেবে আপিল আবেদনের শুনানির জন্যে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এর কয়েক সপ্তাহ আগে মামলাটি শুনানি করে দেয়ার জন্যে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হুমায়ুন কবির তাকে বলেন। তারই পরামর্শে আসিফ হাসান মামলাটি শুনানির জন্যে ওকালতনামা নেন। এরপর এসে তিনি তাকে ফোন করে জানান, মামলার দু’ আসামির মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়ে গেছে। এর আগে তিনি জানতেন না যে আসামিদের দন্ড কার্যকর হয়েছে।
আইনজীবীরা বলছেন,নিয়ম অনুযায়ী বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ড হলে তা কার্যকর করতে অনুমতি প্রয়োজন হয় হাইকোর্টের। হাইকোর্টে মৃত্যুদন্ড অনুমোদন হওয়ার পর তা কার্যকর করতে আরও কিছু প্রক্রিয়া মেনে চলতে হয়। তবে, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে মামলার কোনো পক্ষ যদি আপিল দায়ের করে সে ক্ষেত্রে তা নিষ্পত্তির জন্যে অপেক্ষা করতে হয় কারা কর্তৃপক্ষকে।
অথচ সেই নিয়মের বাইরে গিয়ে আপিল নিষ্পত্তির আগেই চুয়াডাঙ্গার মোকিম ও ঝড়ু নামে দু’ আসামির মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেছে যশোর কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষ। আইনজীবীরা জানান, মামলার এজাহারে মোকিম ও ঝড়ুর নাম আসে। পরে ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল বিচারে তিনজনের মৃত্যুদন্ড, দু’জনকে যাবজ্জীবন ও অপর আসামিদের খালাস দেন চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-২। মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রাপ্তরা হলেন, একই ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, মোকিম ও ঝড়ু।
এরপর বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুসারে আসামিদের মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমোদনের জন্যে মামলাটি হাইকোর্টে আসে। মামলার ডেথ রেফারেন্স নম্বর ছিল ৩৯/২০০৮। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল রেখে ২০১৩ সালের ৭ ও ৮ জুলাই মামলার রায় ঘোষণা করেন। বাকি আসামিদের খালাস দেন।
পরে মোকিম (আপিল নং- ১১১/২০১৩) ও ঝড়ু (আপিল নং- ১০৭/২০১৩) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন। তখন মোকিমের পক্ষে আপিল মামলাটি তদারকির দায়িত্ব পান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হুমায়ুন কবির। এরপর দীর্ঘ আট বছর চলে গেছে। সম্প্রতি আপিলটি শুনানির জন্যে আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ওঠে। মামলাটি শুনানির জন্যে তালিকায় ওঠার পর দরিদ্র মোকিমের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইনজীবীরা জানতে পারেন আপিল নিষ্পত্তির আগেই ২০১৭ সালে মোকিমের ফাঁসি কার্যকর করেছেন কারা কর্তৃপক্ষ। এমনকি অপর আসামি ঝড়ুর মৃত্যুদন্ডও কার্যকর করা হয়েছে বলে জানা যায়।
নিয়ম অনুসারে, হাইকোর্ট কর্তৃক কোনো আসামির মৃত্যুদন্ড অনুমোদনের পর আপিল দায়ের করা হলে আপিল বিভাগ থেকে কারা কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট ডিসির কাছে এ বিষয়ে নির্দেশনা যায়। ফলে, দন্ড কার্যকর ওই সময়ের জন্যে বন্ধ রাখা হয়।
তদারকি করতে গিয়ে আইনজীবী হুমায়ুন কবির নিজেও ঘটনার সত্যতা খুঁজে পান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিচারপ্রার্থী মোকিম কনডেম প্রিজনার ছিলেন। বিচারপ্রার্থীর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হন, কনডেম প্রিজনার মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদন্ড এরইমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে। মূলত মোকিম ও ঝড়ুর পরিবার খুবই দরিদ্র। তাই তাদের পক্ষে পরিবারের সদস্যরা সেভাবে মামলার বিস্তারিত খোঁজ নিতে পারেননি। সে সামর্থ্যও তাদের ছিল না বলে জানিয়েছেন ওই আইনজীবী।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামের মৃত রবকুল মন্ডলের মেঝ ছেলে মনোয়ার হোসেনকে ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন গ্রামের বাদল সরদারের বাড়িতে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা কুপিয়ে হত্যা করে। ওই দিনই নিহতের ভাই অহিম উদ্দীন বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় ২৬ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত। রায়ে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির দু’ আঞ্চলিক নেতা দুর্লভপুরের মৃত মুরাদ আলীর ছেলে আব্দুল মোকিম ও একই গ্রামের মৃত আকছেদ আলীর ছেলে ঝড়ুসহ তিনজনকে মৃত্যুদন্ডাদেশ এবং দুর্লভপুরের মৃত কুদরত আলীর ছেলে আমিরুল ইসলাম ও একই গ্রামের আবু বক্করের ছেলে হিয়াসহ দু’জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ দেয়া হয়। বাকি আসামিদের বেকসুর খালাস দেন আদালত। মামলার রায় ঘোষণার পর উচ্চ আদালতে আপিল করেন আসামির স্বজনরা। আপিল বিভাগে ওই আবেদনের শুনানি শেষে এক রায়ে ফাঁসির দন্ডাদেশপ্রাপ্ত এক আসামি ও যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশপ্রাপ্ত দু’জন আসামি আমিরুল ইসলাম ও হিয়ার দন্ডাদেশ মওকুফ করা হয়। মোকিম ও ঝড়ুর ফাঁসির আদেশ বহাল থাকে। এরপর ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর রাত পৌঁনে ১২টায় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে মোকিম ও ঝড়ুর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এদিকে, বুধবার আপিল নিষ্পত্তির আগেই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০১৭ সালে দু’ আসামির ফাঁসি কার্যকর হওয়ার খবরে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। তবে,কারাগার সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আইনগত সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর মোকিম ও ঝড়ুর ফাঁসি কার্যকর করা হয় সেই সময়। সূত্রের দাবি,আপিল বিভাগে মৃত্যুদন্ড বহাল থাকার পর এই দু’ আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে মৃত্যুদন্ড মওকুফের আবেদন করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি এই আবেদন নামঞ্জুর করেন। ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সহকারী সচিব মোহাম্মদ আলী স্বাক্ষরিত এক পত্রে আবেদন নামঞ্জুরের বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। এরপর আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ১৬ নভেম্বর রাত পৌঁনে ১২টায় তাদের দু’জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ওই রাতেই নিহত দু’জনের লাশ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে কারা কর্তৃপক্ষ। সে সময় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলর ছিলেন আবু তালেব।
বর্তমান জেলার তুহিন কান্তি খান বলেন, ‘এ ধরনের খবর শোনার পর আমি নিজে ফাইলপত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছি। কোথাও কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়নি। রাষ্ট্রীয় আইনগত সকল বিধিবিধান মেনেই দু’ আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
খুলনা বিভাগীয় কারা উপমহাপরিদর্শক ছগির মিয়া সাংবাদিকদের জানান, ‘আপিল নিষ্পত্তির আগেই যশোর কারাগারে ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর দু’ আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে-এমন খবর তাদের নজরে এসেছে। কারা কর্তৃপক্ষ কাগজপত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিষয়টি পরিষ্কার হবে।’

খন্দকার তরিকুল ইসলাম
যশোর প্রতিনিধি

প্রিয় পাঠক, স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিও আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, cbnnews04@gmail.com ঠিকানায়। অথবা যুক্ত হতে পারেন chinabanglanews আমাদের ফেসবুক পেজে। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।

এই বিভাগের আরও খবর

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

আমাদের লাইক পেজ

- Advertisment -spot_img

জনপ্রিয় পোস্ট