


ছোট গল্প : রুম নম্বর ১০৭
পর্ব। : ২য় ও শেষ
লেখক : মোঃ রাজন ইসলাম
ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে পুরো শহর। অতিরিক্ত কুয়াশার কারণে পাঁচ মিটার সামনে কি আছে তা দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে । সাথে বজ্রপাতের দানবীয় শব্দে কিছুক্ষণ পরপর কেঁপে উঠছে পুরো শহর । পুরো শহর যেন একদম নিশ্চুপ কোথাও পাখির কোলাহল, চেঁচামেচি নেই, বাইরেও কোন মানুষের চলাচল নেই । এ যেন নিস্তব্ধ নিষেধাজ্ঞার মতো একটি শহর যেখানে সবকিছুই থমকে দাঁড়িয়েছে। মহাপ্লাবন শুরু হবার যেন পূর্বাভাস দিচ্ছে প্রকৃতি।
এত কিছুর পরেও এমেলিয়া যেন এই জগতের কেউ না। সে বাস করছে নিজের প্রশ্নের জগতে, এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না কি হয়েছিল কাল রাতে । ফ্রেড কোথায়? কে সে? রবার্ট-ই বা কেন সেই রকম দানবীয় রূপ ধারণ করেছিল সেই-ই বা কে ? । তাহলে কি এ সব কিছুই স্বপ্ন ছিল? তাহলে এই চিরকুট আসলো কোথায় থেকে, । রবার্ট এর কথা মনে পড়তেই মোবাইলটা খোঁজাখুঁজি শুরু করলো এমেলিয়া, রবার্ট কে একটা কল করতে হবে এখনই। মোবাইলটা হাতে নিয়েই কল করতে যাবে এমন সময় দেখে রবার্ট নামে তার ফোনে কোন নামই নেই;!! গত রাতের কল লিস্ট চেক করলেও সেখানেও কোন নাম্বার দেখতে পায় না। কি হচ্ছে তার সাথে কোন কিছুই বুঝতে পারছে না এমেলিয়া। এ যেন পাগল হবার অনুক্রম।
হঠাৎ তার চোখ যায় দেয়ালে টাঙানো ফ্যামিলি ফটোটার দিকে। গতরাতে সে দেখতে পেয়েছিল রবার্টের সামনে দাঁড়ানো ফ্রেড গায়েব হয়ে গেছে, আজকে সেখানে রবার্টের ছবিটাও নেই। পুরো মস্তিষ্ক যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছে না। সকল প্রশ্নের উত্তর হয়তো এক জায়গা থেকেই পেতে পারে আর তা হল এই হাতে থাকা চিরকুটটা। তাই আর দেরি না করে চিরকুট টা খুলে পড়তে লাগলো।
( ডিয়ার মম এতক্ষণে হয়তো তোমাকে নিজের কাছে নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে, অস্বাভাবিক বা অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে যেমনটা আমাকে তোমরা ভাবতে। কিন্তু আমি মোটেও অস্বাভাবিক ছিলাম না, আমি ছিলাম স্বাভাবিক এবং সুস্থ একজন যেমনটা তুমি। বুঝতে পারছি তোমার মনে এই মুহূর্তে রয়েছে হাজারটা প্রশ্ন ছিঁড়ে খাচ্ছে তোমার মস্তিষ্কের নিউরন গুলোকে। আমাদের চারপাশে রয়েছে হাজার প্রশ্ন কতটুকুই বা আমরা জানি ? সবকিছু জানার প্রয়োজন নেই। তবে কিছু প্রশ্নের উত্তর তোমার হয়তো জানা প্রয়োজন।
আমি কখনোই তোমার সন্তান বা ফ্রেড ছিলাম না। কে ছিলাম সেটা না হয় নিজেই খুঁজে নিও!!
হাজারো কোটি মানুষের মধ্যে কতজনকেই বা আমরা চিনি কতজনকেই বা আমরা জানি। তাদের সাথে হয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছে অশরিরীয় হাজারো আত্মা, হয়তো কোন অশুভ আত্মা রূপ ধরে আছে কয়েকশো বছর ধরে।
আমি রবাটকে কখনোই চিনতে পারতাম না কারণ সে কখনোই এক রূপে থাকতো না।
বাহ্যিক চেহারা সে হয়তো সবার থেকে সবসময় গোপন করে রাখত কিন্তু তার আত্মা তার ভেতরের চেহারা আমি সবসময় দেখতে পেতাম। সে কখনোই তোমার হাজবেন্ড ছিল না। সে ছিল বহুরূপী একটি পিশাচ মায়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছিল তোমাকে দিনের পর দিন মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর। তুমি সেটা বুঝতে পারোনি পাড়ার কথাও না!!.
রবার্ট যখন জানতে পারে যে আমি তার সবকিছু জেনে গেছি তখন সে আমাকে খুঁজতে শুরু করে এবং না পেয়ে তোমার ওপর তার দানবীয় চেহারা ধারণ করে আক্রমণ করে। তোমার পেটের ক্ষতটা কোন কাকতালীয় বা স্বপ্ন ছিল না সেটা ছিল বাস্তব। আমাকে এতদিন ধরে বড় করার জন্য ধন্যবাদ মম, তাই তোমার জীবন রক্ষা করতে এতোটুকু আমি করতেই পারি। পৃথিবীর কত হাজার লক্ষ রহস্য আছে কতটুকুই আমরা জানি কতই বা জেনেছি!!…….
ফ্রেড…………)
চিরকুটটা পড়ার পর কিছুক্ষণের জন্য নিঃশব্দ হয়ে পড়ে এমেলিয়া, যেন তার হৃদস্পন্দন ও চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। ভাবতে থাকে তার এখন কি করা উচিত। সবকিছু যেন বুঝেও কোন কিছুই বুঝতে পারছে না সে। হঠাৎ তার মাথায় আসে সেই সাইকেট্রিসের সাথে একবার দেখা করা খুবই জরুরি। যেই ভাবা সেই কাজ আর দেরি না করে সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়ে এমেলিয়া। বের হওয়ার আগে ডাইনিং রুমে থাকা ছবিটার দিকে আরেকবার দেখে সেখানে তাদের তিনজনের ছবি থাকলেও এখন সে একা দাঁড়িয়ে আছে।
বাইরে তুমুল শীতের মাঝে জোরে বাতাস বইছে, সাথে মুষলধারে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি তো লেগেই আছে। গাছের সোনালী পাতাগুলো ঝরে গিয়ে ফাঁকা রাস্তাটা যেন ভরে গেছে।
সাইকিয়াট্রিসের অফিসে রুমে ঢুকতেই ডক্টর বলে উঠল
ডক্টর: Good Morning Mis…..
এমেলিয়া: এমেলিয়া স্যার। আমি আপনার এখানে কিছুদিন আগে এসেছিলাম আমার হাজব্যান্ড রবার্ট এবং আমার ছেলে ফ্রেড কে সাথে নিয়ে।
ডক্টর : সরি মিস এমেলিয়া but আমার লিস্টে এই নামে কোন রোগী নেই. আমার মনে হয় আপনি কোথাও ভুল করছেন।
এমেলিয়া : হঠাৎ রেগে গিয়ে চিৎকার করা শুরু করলো, “আপনি ভুল করছেন, আপনি মনে রাখতে পারেন না” কিছুদিন আগেই আপনার এখানে এসেছি আমরা এবং আপনি বলেছিলেন রবার্ট কে কল দিয়ে নেক্সট টাইম ডেকে নিবেন। কথাগুলো বলতে বলতে এমিলিয়া কান্না শুরু করে দিল আর বলতে লাগলো প্লিজ স্যার মনে করার চেষ্টা করুন। আপনি একমাত্র আমার সমস্যার সমাধান দিতে পারবেন। প্লিজ স্যার প্লিজ
ডক্টর : একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল ok মিস এমেলিয়া বলুন আপনার সমস্যা কি ? শুনি।
এমেলিয়া শুরু থেকে একে একে সব ঘটনা খুলে বলতে শুরু করল। তার সাথে যা যা কিছু ঘটেছে ফ্রেডের ব্যাপারে রবার্ট এর ব্যাপারে এমনকি সেই চিরকুটে কি লেখা সেটাও বলল।
দুই পাশেই নিঃশব্দ এ যেন এক মহাকাব্য শেষ করল এমেলিয়া।
ডক্টর : অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর, আপনার সেই চিরকুট টা কি আমি দেখতে পারি?
এমেলিয়া : অবশ্যই স্যার ব্যাগ থেকে চিরকুটটা বের করে দিয়ে বলল এই নেন।
ডক্টর : কিছুক্ষণ সেটা ভালো করে পড়ে দেখার পর বলতে শুরু করলো, দেখুন মিস এমেলিয়া আমি আপনাকে কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি আপনি সেগুলো খাবেন আর চেষ্টা করবেন বেশি ঘুমানোর জন্য।
এমেলিয়া : আপনার মনে হয় আমি অসুস্থ,? একটু রাগান্বিত কন্ঠে বলল এমেলিয়া” আমি এতক্ষণ যা বললাম সবকিছু মনগড়া কাহিনী? সবকিছু মিথ্যা বলে আপনার মনে হয়?
ডক্টর : দেখুন মিস এমেলিয়া আপনি রেগে যাবেন না প্লিজ আমি আপনার সমস্যাটা বুঝতে পারছি । আপনি প্লিজ শান্ত হন আমাকে বলতে দেন।
আমাদের সাবকনশিয়াস মাইন্ড কিন্তু আজব একটি জিনিস , আপনি নিজেও হয়তো জানবেন না যে আপনার সাথে কি ঘটে যাচ্ছে। এটাকে অনেকটাই ম্যান্ডেলা ইফেক্ট বলতে পারেন,যার মানে আপনি নিজেই নিজের মধ্যে একটি অবাস্তব জগৎ গড়ে তুলবেন এবং সেখানে মিশে থাকবে আপনার সেই সব ঘটনা যেগুলো আপনি বাস্তব জীবনে পেতে চেয়েছেন কিন্তু সেটা পাননি মিশে থাকবে আপনার আবেগ অনুভূতি সবকিছু ।
এমেলিয়া : আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি পাগল ? অসুস্থ?
ডক্টর : আমি ঠিক সেটা বলতে চাচ্ছি না আপনাকে আপনি বোঝার চেষ্টা করুন।
এই কথা বলার মাঝেই হঠাৎ এমেলিয়া বলে উঠলো
এমেলিয়া : আপনি ছোট থাকতে অনেক দুর্বল ছাত্র ছিলেন এই চাকরিটা আপনার বাবার জন্য পেয়ে গেছেন।
ডক্টর : বাইরের বজ্রপাতের মত তার ভেতরেও যেন একটা ঝড় বয়ে গেল কিছু মুহূর্তের জন্য।
এমেলিয়া : আপনার প্রথম সন্তান মারা যাওয়ায় আপনি একটুও কষ্ট পাননি । কেন স্যার?
ডক্টর : এবার যেন চোখ কপালে ওঠার অনুক্রম। অনেক কষ্টে বলল আপনি এসব কি করে জানেন?
এমেলিয়া : আগেরবার আপনার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম তখন ফ্রেড আপনাকে এই দুটো কথাই বলেছিল এরপরও আপনার মনে হচ্ছে এগুলো মনগড়া কথা স্যার?
ডক্টর : কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর মুখ খুলল। আচ্ছা আপনার হাজবেন্ডের নাম কি বললেন যেন ?
এমেলিয়া : রবার্ট
ডক্টর : তার সাথে আপনার কত বছরের সম্পর্ক?
এমেলিয়া : অনেকক্ষণ ভাবার পরে। “এই ধরেন আট বছর”
ডক্টর : আপনি বলছেন ফ্রেড আপনার সন্তান কিন্তু ফ্রেড বলছে সে আপনার সন্তান না । ব্যাপারটা পরিষ্কার না আমার কাছে এই ব্যাপারে কি আরো কিছু বলতে পারেন?
এমেলিয়া : ফ্রেড আমার সন্তান স্যার ।আপনি বিশ্বাস করেন (অনেকটা কান্নার স্বরে বললেন এমেলিয়া)
ডক্টর : এখানে বিশ্বাসের বা অবিশ্বাসের কোন কথা আসছে না মিস এমেলিয়া। (কথাটা বলতে বলতে একটি সিগারেট ধরালেন ডক্টর) ফ্রেডের জন্মের প্রথম থেকে সব জানতে চাচ্ছি।
এমেলিয়া : আমার এখনো মনে আছে সাত বছর আগে আমাদের বাড়ির কাছেই একটি সরকারি হাসপাতালে ১০৭ নম্বর রুমে ফ্রেডের জন্ম হয়। জন্মের পর থেকেই সে ছিল অস্বাভাবিক তাকে কখনো কান্না করতে দেখিনি আমি।
ডক্টর : আচ্ছা আপনি বলছিলেন ফ্রেড প্রায় সময় অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলতো। কি বলতো সে?
এমেলিয়া : সেগুলো অনেকটাই আশ্চর্যের কথা স্যার, এই যেমন একদিন রবার্টকে দেখা মাত্র বলল পিরামিড তৈরিতে কত মানুষের বলি দিতে হয়েছে, আরেকদিন বলল দেবতাদের শাসনামল কেমন ছিল?এই ধরনের অদ্ভুত কথা আছে ।
ডক্টরের দুচোখ খুলে বাইরে আসার ন্যায় , এমেলিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল OH MY GOD
এমেলিয়া : কি হলো স্যার?
ডক্টর একদম নিশ্চুপ । মাথায় একটা হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল ।
এমেলিয়া : স্যার কিছু বলুন প্লিজ।
কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটলো দুজনের। একটু পরে ডক্টর আবার বলতে শুরু করলো ।
ডক্টর : আরেকটি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল “আপনি বলছেন ফ্রেড 107 নম্বর রুমে জন্মগ্রহণ করে। সেই সময় নিশ্চয় রবার্ট আপনার পাশেই ছিল ?
এমেলিয়া : জী স্যার
ডক্টর : Good but i’m sure that আপনি নিশ্চয়ই আপনার পরিবারের পরিচয় জানেন না এবং আপনার বাবা-মা কে আপনি সেটাও বলতে পারবেন না ?
এমেলিয়া : ডক্টরের দিকে হতবাক হয়ে বাক প্রতিবন্ধীর মত তাকিয়ে আছে কারণ তার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই।
ডক্টর : চেয়ার থেকে উঠে এদিক সেদিক হাটতে শুরু করল হাতে তার সিগারেট। সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন ?বলল ডক্টর।
এমেলিয়া : অনেকটা ইতস্তত বোধ করে বলল বুঝলাম না স্যার।
ডক্টর : মানে সবকিছুই কেউ একজন সৃষ্টি করেছে মানুষ পশু পাখি ( এমেলিয়ার সামনে এসে বলল) জিন, অশুভ আত্মা, পিশাচ, পৃথিবীর বাইরেও অনেক প্রাণী থাকতে পারে ।এসব কি আপনি বিশ্বাস করেন?
এমেলিয়া : নিশ্চুপ ।কোন কথা নেই। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন স্যার ?
ডক্টর : খুব সহজ ভাষায় বললে ফ্রেড যা বলেছে তা সব কিছু সত্য।
এমেলিয়া : কোন সত্যের কথা বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
ডক্টর : এটাই যে রবার্ট আপনার হাসবেন্ড নয় এবং ফ্রেড ও আপনার সন্তান নয়।
এমেলিয়া : but আমি সেটা কিভাবে মেনে নেব স্যার?
ডক্টর: একটু উচ্চকণ্ঠে বললেন “কারণ আপনি জানেন না আপনার অস্তিত্ব কি, আপনার পরিবার কোথায়, আপনার বাবা-মা কে and that’s mean আপনি এতদিন কোন অসুভ আত্মার বসে ছিলেন এবং আছেন।
এমেলিয়া : এ যেন আকাশ থেকে পড়ল এমন অবস্থা।
ডক্টর : আমি আপনার মানসিক চাপটা বুঝতে পারছি মিস এমেলিয়া but এটাই সত্যি আর এটাই আপনার মেনে নেওয়া উচিত।
এমেলিয়া : ok but স্যার ফ্রেড এর ব্যাপারে আপনি কি বলবেন? আমি ছোট থেকে নিজের হাতে মানুষ করেছি তাকে, সে আমার ছোট্ট ফ্রেড কান্না করতে করতে বলল এমেলিয়া।
সত্যি বলতে এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছেও নেই এই মুহূর্তে। কিন্তু আমি এই প্রশ্নের উত্তর বের করেই ছাড়বো । এই রহস্যের সমাধান বের করবই,
আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
এমেলিয়া : আমি তাইলে এখন কি করব?
ডক্টর : আপনি আপাতত বাড়ি ফিরে যান, এবং কয়েকদিন বিশ্রাম নিন আর যতটা সম্ভব সবকিছু ভুলে থাকার চেষ্টা করেন । চাইলে কোন জায়গায় ঘুরতে যেতে পারেন।
এমেলিয়া : কিছু না বলে ব্যাগটা নিয়ে উঠে পড়ল গেট দিয়ে বের হবে এমন সময় পেছনে ফিরে বলল “আপনি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন ?”
ডক্টর : welll আমি মনে করি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব রয়েছে । যুক্তি দেই, অণু-পরমাণুতে ধাক্কাধাক্কির ফলে একটা জটিল অণুর জন্ম হয়েছে। একসময় এটা এত দূর জটিল হয়ে উঠছে, সেটা একেবারে নিজের মতো আরেকটা জিনিস তৈরি করতে শুরু করেছে। তারপর তৈরি হলো মানুষ। অসম্ভব ধীমান একটি প্রাণী। একটা গোলাপ ফুল দেখে যে মানুষ তারিফ করতে পারে, একটা পরম শৃঙ্খলা ছাড়া শুধু ধাক্কাধাক্কি করে কি এটা সম্ভব হতে পারে? এবং এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে অণু-পরমাণুর ধাক্কাধাক্কির ফলে আমরা গোলাপ ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি? এই পৃথিবীর সবকিছু পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনে চলে। প্রোটন হবে ইলেকট্রনের চেয়ে ১,৮৩৬ গুণ বড়। সমস্ত তত্ত্ব, সংখ্যা ধ্রুব। এই ধ্রুবত্ব কে নির্ধারণ করেছে?
এমেলিয়া আর কিছু না বলে সোজা বের হয়ে চলে গেল। রাস্তায় এখনো মুষলধারে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে ইতিমধ্যে দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে যাচ্ছে কিন্তু কোন রোদের দেখা নেই।
রাস্তা পার হয়ে বাড়িতে ঢুকেই ডাইনিং রুমের গেটটা খুলে এমেলিয়ার চোখ দুটি গেল দেয়াল টাঙানো সেই ছবিটার দিকে এবং ছবিটা দেখামাত্র জ্ঞান হারিয়ে ওইখানেই পড়ে গেল এমেলিয়া। যেখানে শুধু এমিলিয়া দাঁড়িয়েছিল সেখানে এখন কেউ নেই, একদম ফাঁকা শুধুমাত্র একটি ফ্রেম ঝুলানো আছে।…..………
বাহিরে গ্রীষ্মের গরম। প্রচন্ড রোদে পথচারী সবাই ক্লান্ত, পাশে একটা আইসক্রিম শপ রয়েছে। গ্রীস্মের এই দাপটে গরমে সেটাই যেন পথিকদের একমাত্র সাথী। বাচ্চা থেকে বয়স্ক সবাই আইসক্রিম কিনছে সেখান থেকে।
পাশেই রয়েছে একটি সরকারি মেন্টাল হসপিটাল সেখানেই মূলত এসেছে হেনরি এবং তার স্ত্রী লিলি। দীর্ঘ একমাস পর তাদের মেয়েকে দেখতে এসেছে তারা।
এমেলিয়া ছোট থেকে ছিল অস্বাভাবিক এবং অসুস্থ একটি মেয়ে। প্রথমে সেগুলো সবার নজরে না পড়লেও যতদিন অতিবাহিত হতে লাগলো ধীরে ধীরে তা সবার নজরে আসতে শুরু করলো যেমন- রাতে মাঝে মাঝে ঘুমের ভেতরে হাটা, একা একা বাড়ির ছাদে গিয়ে রাতে আকাশের দিকে চেয়ে বসে থাকা, নিজে নিজে সুইসাইড করতে চাওয়া, এছাড়াও নিজের শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি। এই সবই শুরু হয়েছে ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সে । প্রথমে হেনরি এবং লিলি তাদের মেয়েকে স্বাভাবিক মনে করলে ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারে তাদের মেয়ে স্বাভাবিক না। তারা সিদ্ধান্ত নেয় একজন ভালো ডাক্তার দেখানোর। ডক্টরের কাছে গেলে তারা সিদ্ধান্ত দেয় কিছু দিনের জন্য তাদের মেয়ে কে মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করার জন্য। সেখানে সুস্থতার শতভাগ ভরসা দেয়। কিছুদিনের জন্য বললেও আজ প্রায় দীর্ঘ সাত বছর যাবত এমেলিয়া মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি। না কারো সাথে কথা বলে না অনুভূতি আছে আর না কিছু জানতে চাই। এ যেন একটি জীবিত লাশ। অনেক ধরনের চিকিৎসার পর এখন ডক্টরও হার মেনে নিয়েছে । বাকি জীবন টুকু এমেলিয়ার ওই 107 নম্বর রুমেই হয়তো কেটে যাবে।
৪ টা বেজে ২০ মিনিট । হেনরি এবং লিলি তাদের মেয়ের জন্য আজ বেশ কিছু চকলেট এবং আইসক্রিম নিয়ে এসেছে। হসপিটালে ঢুকতেই সোজা সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় উঠে গেল তারা দুজনে। ছয় তলা বিশিষ্ট এই ভবনে তৃতীয় তলায় চতুর্থ গলিতে রয়েছে 107 নম্বর রুম। রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল এমেলিয়া চুপ মেরে একটি কোনায় বসে আছে। তারাও রুমে ঢুকে তার পাশে বসে পড়ল কিছু বলতে যাবে এমন সময় এমেলিয়া তার সাথে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা বলতে শুরু করলো। হেনরি এবং লিলি শুধু হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো কারণ ২২ বছরে এই প্রথম তাদের মেয়ে তাদের সাথে কিছু কথা বলল। এমেলিয়া তার সাথে ঘটে যাওয়া সব বলতে থাকলো, ফ্রেড এর কাহিনী রবার্টের কাহিনী সাইকিয়াট্রিসের সাথে কি কি বলেছে সে সব কথা।
হেনরি এবং লিলি খুবই মনোযোগ দিয়েছে এসব কথা শুনছিল। তাদের মনে শুধু একটা কথা আসছিল- তাদের মেয়ের মনে কি সব চলে এগুলো, এই পরিস্থিতি থেকে কিভাবে তারা ঠিক করবে সবকিছু। এমেলিয়া সব কিছু বলতে বলতে প্রচন্ড ঘেমে যাচ্ছিল এমন ভাবে সব বলছিল এজন্য কালকেই ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা। পরিশেষে শুধু একটি কথা বারবার বলছিল আমার ফ্রেড ফিরে আসবে আমার ফ্রেড ফিরে আসবে।
এমেলিয়ার এরকম করুন অবস্থা দেখে লিলি তার চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না, তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো। কিন্তু হেনরির মনে কিছুটা হলেও ঘটকা লাগলো যে মেয়ে আজ পর্যন্ত কারো সাথে কথা বলেনি সে মেয়ে কিভাবে এত কিছু জানল কোথায় পেল এসব?. ওইদিকে এমেলিয়া আমার ফ্রেড আসবে বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে। হেনরি এবং লিলি তাকে রেখে দ্রুত ডক্টরের সাথে কথা বলতে যাই। হেনরির কেননা জানি মনে হচ্ছে এসব কিছুর পেছনে কোন না কোন কারণ অবশ্যই আছে। ডক্টর কে সব কিছু খুলে বললে ডক্টর একটু হাসে আর বলে-
ডক্টর : হাহাহা সরি মিস্টার হেনরি but এটা মেন্টাল হসপিটাল এখানে যাদের দেখতে পাচ্ছেন কেউই নরমাল না সবাই এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে যা শুনলে যে কারো সত্যি মনে হবে।
হেনরি : কিন্তু স্যার তবুও আমার মনে হয় এমেলিয়ার এসব কথা বলার পেছনে কোন কারণ আছে আপনি প্লিজ একবার দেখুন।
ডক্টর : দেখুন স্যার আপনার সমস্যা আমি বুঝতে পারছি কিন্তু দীর্ঘ ৩০ বছরের অভিজ্ঞতায় এই সবই এখন আমার কাছে নিত্যদিনের ঘটনা। আচ্ছা ঠিক আছে আপনি চিন্তা করবেন না আপনার জন্য আমি একটা নার্সকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ইন্টারকমটা তুলেই ডক্টর একজন নার্সকে তার অফিস রুমে ডাকলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই নার্স চলে আসলো,
জি স্যার আমাকে ডেকেছেন?
হ্যাঁ আপনি প্লিজ এনাদের সাথে নিয়ে রুম নাম্বার হুমম!
মিস্টার হেনরি কত নম্বর রুমে আছে আপনার মেয়ে?
হেনরি : জি স্যার রুম নাম্বার ১০৭
ডক্টর : কত নম্বর বললেন?
হেনরি : ১০৭ ( ওয়ান জিরো সেভেন ) একটু চিৎকার করে রাগান্বিত কন্ঠে বললেন।
ডক্টর : নিচের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দিয়ে বললেন স্যার আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে!
হেনরি : আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?
ডক্টর : একদম নয় স্যার but ১০৭ নাম্বার রুম বলতে আমাদের এখানে কোন রুম নেই।
হেনরির এক নজরে এমেলিয়ার বলা সব কথাগুলো মনে পড়ে গেল কিভাবে ফ্রেড একের পর এক তার সব স্মৃতি মুছে দিচ্ছিল। পরক্ষণেই হেনরি জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো “What the hell” আপনি কি বলছেন মাথা ঠিক আছে তো ডক্টর? আমার মনে হয় এই হসপিটালে মেন্টাল রোগীদের সাথে থাকতে থাকতে আপনার মাথাটাও পাগল হয়ে গেছে, বয়স হয়ে গেছে আপনার ভালো হবে এখনি রিটাইয়ারমেন্ট নিয়ে নেন, তা না হলে এই হসপিটালে নিজের জন্য একটা রুম বরাদ্দ করে নেন।
ডক্টর : দেখুন মিস্টার হেনরি আপনি তখন থেকে যা নয় তা বলে যাচ্ছেন । আমি এই হসপিটালের সবথেকে সিনিয়র ডক্টর এই হসপিটালের প্রতিটা অলিগলির ইট আমার চেনা আমাদের এখানে ১০৭ নম্বর বলে কোনো রুম নেই।
হেনরি : ok তো চলুন আমার সাথে আমি নিয়ে যাচ্ছি।
ডক্টর : চলুন
হেনরি লিলি ডক্টর এবং নার্স সবাই মিলে তৃতীয় তলায় চতুর্থ গলিতে গেলেও সেখানে ১০৭ নাম্বার রুমটা নেই কাকতালীয় ভাবে সেটা গায়েব। ডক্টর বললেন দেখুন মিস্টার হেনরি এটা ১০৬ এবং পরের একটা ১০৮ এই বিল্ডিং এ ১০৭ নম্বর রুম নেই।
হেনরি : but স্যার এখানেই ছিল, এই যে আমি দাঁড়িয়ে আছি ঠিক এখানেই গেটটা ছিল, সত্যি বলছি আমি বিশ্বাস করুন । মিথ্যা কেন বলব?
ডক্টর : আপনি মিথ্যা বলছেন না আপনার জন্য এই হসপিটালে একটি রুম বুক করে দেই তাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে হাহাহা। এই বলে ডক্টর নার্সকে সাথে নিয়ে চলে গেল
সাথে সাথে লিলি দ্রুত কাউন্টারের দিকে রওনা হলো এমেলিয়ার ফাইল খুঁজতে।
হেনরি পেছন থেকে ডেকেই যাচ্ছে স্যার আমার কথাটা তো শুনুন প্লিজ।
হেনরি তৃতীয় তলায় একাই দাঁড়িয়ে আছে তখনই জানালা দিয়ে এক আজব ঘটনা দেখতে পেল সে। হসপিটালের পেছনের বড় মাঠটি থেকে এক আজব বড় আলোর রশ্মি উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে সেটা রাতের অন্ধকারের সাথে মিশে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা হারিয়ে গেল অসীম আসমানে । হেনরি নিঃশব্দে শুধু সেটা দেখে যাচ্ছিল ।
পরক্ষণেই লিলি নিচে থেকে উঠে আসার সাথে সাথে কিছু বলার আগেই হেনরি বলল “জানি কোন ফাইল পাওয়া যায়নি”
এই পৃথিবীর পুরোটাই কি আমরা জানি?আসলে এই পৃথিবীর অনেক কিছুই আমাদের অজানা।এ পৃথিবী যেন একটি আজব জায়গা। প্রকৃতি সবসময়ই রহস্য পছন্দ করে। পছন্দ করে রহস্যের বেড়াজালে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে। কিছু রহস্য অন্ধকারে চেপে রাখায় ভালো । না কোনো দিন আলোর পথ দেখেছিল, না দেখছে আর না কোনো দিন দেখবে। অনন্তকালের এই রহস্যের শেষ কোথায়? তা তো শুধু তিনিই জানেন যিনি পরমানু থেকে শুরু করে বিগ ব্যাং সৃষ্টি করেছেন।
সমাপ্তি……………
দয়া করে গল্পটি কেউ কপি করলে অবশ্যই ক্রেডিট দিবেন।