চুরুলিয়ার গৈরিক মাটি, তপ্ত হাওয়া, দরিদ্র গ্রাম্য পরিবেশে অসচ্ছল মুসলিম পরিবারে অবহেলায় আর দুঃখ-দুর্দশায় বেড়ে উঠেছিলেন বাংলার ধুমকেতু কাজী নজরুল ইসলাম।
কী করে তিনি দুখু মিয়া থেকে নজর আলী, নজর আলী থেকে নজরুল এসলাম, নজরুল এসলাম থেকে নজরুল ইসলাম হলেন তা সত্যিই আগ্রহব্যঞ্জক।
বাবা কাজী ফকির আহমেদ ও মা জাহেদা খানমের সন্তান। পিতামহ কাজী আমিনুল্লাহ। আদিবাড়ি ছিলো পাটনা। বংশটি বাদশাহি আমলে কিছু বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব অর্জনের মাধ্যমে কাজী উপাধি লাভ করেছিল কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কালের পরিক্রমায় কাজী পরিবারটি দারিদ্র্যে উপনীত হয়।
বাবা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও স্থানীয় মাজারের খাদেম, সাথে আয়েমদারী; যার অর্থ হল পতিত জমিতে চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করা।
কাজেই নয় বছর বয়সে নজরুল যখন বাবাহারা হন তখন দারিদ্র্যের কষাঘাত অনুমিতই ছিলো। তাই আমরা দেখি বালক নজরুলকে কখনো পীরের খাদেম, কখনো মসজিদের মুয়াজ্জিন, কখনো ইমামতি , কখনো মক্তবের শিক্ষক, কখনো বা রুটির দোকানের শ্রমিক। এছাড়াও জায়গীরদার থেকে ছাত্রও পড়িয়েছেন কিছুদিন। চাচা লেটোগানের দলের মালিক হওয়ার সুবাদে বালক নজরুল তাঁর দলের সাথে গান গেয়েও উপার্জন করতেন।
এমনভাবেই সংসারের সাথে তাঁর একটা বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। বোধকরি শুধু জীবিকার তাগিদেই নয়, তাঁর বোহেমিয়ান আ্যডভেঞ্চার স্বভাবের কারণেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে চলেছিলেন।
সেজন্য বালক নজরুলকে বড়ো হয়ে উঠতে দেখি চুরুলিয়া, মাথরুন, আসানসোল, রানীগঞ্জ থেকে দরিরামপুরে।
এর মধ্যেই শিয়ারশোল স্কুলে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল ভিত্তি রচিত হলেও তা স্থায়িত্ব ছিলো কেবল দশম শ্রেণি পর্যন্ত।
তাঁর এই বোহেমিয়ান জীবনে যেমন একই সাথে চরম অবহেলার স্বীকার হয়েছেন তেমনি আবার একইভাবে ঋদ্ধ হয়েছেন জীবনের অমূল্য অভিজ্ঞতায়। যা তাঁর প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভার স্ফুলিঙ্গকে দাবানলে পরিনত করতে সহায়তা করেছে সঠিকভাবেই।
এই বন্ধুর পথ-পরিক্রমা নজরুল জীবনকে করেছে শানিত ও উর্বর।
কবি রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন, কারাবাস করেছেন আবার ‘ লাথি মার্ ভাঙরে তালা ‘ বলে বেরিয়েও এসেছেন।
ক্ষনিকের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য পেলেও বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে নিদারুণ আর্থিক কষ্টে। তাই দেখা যায় ম্যালেরিয়া আক্রান্ত অবস্থায়ও পত্রিকা অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন পাওনা টাকা আদায়ের জন্য।
চার বছরের শিশু পুত্র বুলবুলের (অরিন্দম খালেদ) মৃত্যুকে বুকে পাথর চাপা দিয়ে লিখে গেছেন,
‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে,
আমার গানের বুলবুলি..’
বুলবুলের শেষকৃত্যের খরচ যোগাড় করেছেন এই কবিতার স্বত্ব বিক্রি করে।
প্রেম এসেছিলো বারবার তাঁর জীবনে। সৈয়দা খানম (যাকে নজরুল নার্গিস নাম দিয়েছিলেন), ফজিলতুন্নেসা (যিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন), উমা থেকে থিতু হন দুলির (আশালতা / প্রমীলা দেবী) কাছে।
বিধ্বংসী নজরুলের কলম তুলির ছোঁয়ায় স্বতঃস্ফূর্ত যেমন ফুটে উঠেছে ‘বিদ্রোহী’র মতো কালজয়ী কবিতা; তেমনি সৃষ্টি হয়েছে ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানি’র মতো’ হৃদয়-নিংড়ানো ভুবনজয়ী অসাধারণ রোমান্টিক গান।
তারুণ্যের কবি, প্রেমের কবি, বিরহের কবি, বিদ্রোহের কবি- এসব পরিচয় ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি পরিচয়েই হয়ে ওঠেন ভাস্বর ; যুগের থেকে বহুযোজন এগিয়ে থাকা একজন অসাম্প্রদায়িক
মানবতার কবি,
সাম্যের কবি।
‘গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহিয়ান।’
জন্মবার্ষিকীর বিনম্র শ্রদ্ধায়-
লেখক —
মোঃ রিয়াজুল ইসলাম,
(শিক্ষক ও সাংবাদিক)
১২ জৈষ্ঠ্য,১৪২৯ বঙ্গাব্দ।
২৬/০৫/২০২৬
তথ্য উৎসঃ বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও ইন্টারনেট অবলম্বনে।
Leave a Reply